Marquee text

Welcome to My Site

নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেপে রাখা তথ্য



নবাব সিরাজউদ্দৌলার চেপে রাখা তথ্য

নবাব সিরাজউদ্দৌলা সম্পর্কে আমরা প্রচলিত ইতিহাসে যে তথ্য পাই তার অধিকাংশই বানোয়াট। গোলাম আহমাদ মোর্তজা তার চেপে রাখা ইতিহাস বইয়ে তথ্য প্রমাণসহ তা তুলে এনেছেন। এখানে তার বইয়ের ২০২ নং পৃষ্ঠা থেকে হুবহু তুলে ধরলাম-
ভারতের প্রাণকেন্দ্র বঙ্গদেশ, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব ছিলেন সিরাজউদ্দৌলা। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ এবং দালালদের চক্রান্তে তাঁকে, অপর ভাষায় বাংলার স্বাধীনতাকে ধ্বংস করা হয়। তাঁর বীরত্ব ও মহত্বকে ইচ্ছাকৃতভাবে ইতিহাসে বিকৃত করা হয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা রক্ষা করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে যিনি ভারতকে রাঙা করলেন তাঁর ঐতিহাসিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য সামান্যতম চেষ্টার পরিবর্তে বরং অসামান্য অপচেষ্টাই করা হয়েছে।
ম্রাটদের রাজ্যে বঙ্গদেশ একটা প্রদেশ বলে গণ্য ছিলো। বাংলার প্রথম নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। পরে ১৭২৭ সালে তাঁর জামাতা বাংলা ও বিহারের নবাব হন। পরবর্তীতে ১৭৩৯ সালে তাঁর পুত্র সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে বসেন। তিনি যথেষ্ট উপযুক্ত ও শক্তিশালী ছিলেন। তাঁর অধীনস্থ গভর্নর আলীবর্দী খাঁ মারাঠা ও বর্গীদের লুন্ঠন কঠোরভাবে প্রতিরোধ করার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। তাতে সরফরাজ খাঁ খুব একটা গুরুত্ব দেন নি। এতে বীর আলীবর্দীর বীরত্ব প্রকাশে বাঁধার সৃষ্টি হয় দেখে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং সরফরাজকে পরাজিত করে নিজে নবাব হন। নবাব হওয়ার পর তিনি মারাঠীদের অত্যাচার বন্ধ করে জনসাধারনের শুভাশিষ পেয়ে ধন্য হন।
আলীবর্দী খাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিলো না। তাই তার প্রাণপ্রিয় নাতি সিরাজউদ্দৌলাকেই সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। সিরাজের পিতার নাম জয়নুদ্দিন আহমদ। তিনি ছিলেন বিহারের গভর্ণর। তাঁর মায়ের নাম ছিলো আমিনা। এই সিরাজউদ্দৌলার রাজত্বকাল ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আধুনিক ইতিহাসের মিথ্যা দুর্নামের আসরে তাঁর ভূমিকা অতীব বেদনাদায়ক। 
যাহোক, নবাবের সিংহাসন লাভের পরেই নবাবকে অযোগ্য মনে করে ইংরেজরা দুঃসাহসের সাথে কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ তৈরী করতে শুরু করে। ইংরেজরা জানতো সারা ভারতের মস্তিষ্ক বাংলা- তাই কোলকাতাতেই ঘাঁটি তৈরীর পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করতে লাগলো। সিরাজ সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ পাঠালেন যে, দুর্গ তৈরী বন্ধ করা এবং তৈরী অংশ ভেঙে ফেলা নবাবের আদেশ। ইংরেজরা নবাবের আেেদশ অগ্রাহ্য করে দুর্গ তৈরীর কাজ অব্যাহত রাখলো। কারণ, নবাবের সাথে যুদ্ধের জন্য তারা আগে থেকেই তৈরী ছিলো। সিরাজ পূর্ণ সাহসিকতার সাথে বিদেশী ইংরেজকে আক্রমণ করেন এবং তাদের ভীষণভাবে পরাস্ত করেন।
কোলকাতা অধিকারের সংবাদ মাদ্রাজে পৌছালে ব্রিটিশ সেনাপতি ক্লাইভ সাথে সাথে সৈন্য সামন্ত নিয়ে কোলকাতা পুনর্দখল করেন। সিরাজ বুঝতে পারলেন আর যুদ্ধে নামা যাবে না। কারণ ইংরেজদের চক্রান্তে তারই বিশ্বাসভাজন হিন্দু ও মুসলমান বন্ধু বান্ধব দেশশত্রু ইংরেজকে জয়ী করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ফলে বাধ্য হয়েই তাঁকে ১৭৫৬ সালে অত্যন্ত দুঃখ ও বেদনার ইতিহাস রেখে সন্ধি করতে হয়। এই সন্ধি আলীনগরের সন্ধি নামে পরিচিত। সন্ধির শর্ত অনুসারে ইংরেজরা কোলকাতা ফিরে পায়। এবং শুধু ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের মেরামত বা নির্মাণকাজের অধিকার পায়। কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই ইংরেজরা বিশ্বাসঘাতকের মতো হঠাৎ বঙ্গের চন্দননগর দখল করলো এবং সিরাজউদ্দৌলাকে সিংহাসনচ্যুত করার চেষ্টা করলো।
এ ব্যাপারে ইংরেজরা যে বড় অস্ত্র হাতে পেয়েছিলো তা হলো- বঙ্গের বিখ্যাত ধনী জগৎশেঠ, কোলকাতার বড় ব্যবসায়ী উমিচাঁদ আ আমীরচাঁদ এবং রাজা রাজবল্লভ প্রভৃতি দেশের শত্রু ও শোষকবৃন্দ সিরাজ ও দেশের বিরুদ্ধে ইংরেজদের সাথে যোগ দেন। জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন সভা হয়। সেই গোপন আলোচনায় স্ত্রীলোকের ছদ্মবেশে ইংরেজদের দূত মি. ওয়াটস্ সাহেবকে আনানো হয়। ঐ সভায় মি. ওয়াটস্ সকলকে লোভ লালসায় মুগ্ধ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করা হবে এবং তার ফলে বঙ্গ তথা সারা ভারতের মুসলমানদের উত্তেজিত হয়ে ওঠা বন্ধ করতে তাঁরই আত্মীয় মীরজাফরকে সিংহাসনে বসানো হবে। মি. ওয়াটস্ আরও জানালেন, সিরাজের সাথে লড়তে যে প্রস্তুতি ও বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তা বর্তমানে তাদের নেই। তখন জগৎশেঠ শেঠজীর কর্তব্য পালন করতে সদম্ভে আশ্বাস দিয়েছিলেন, টাকা যা দিয়েছি আরো যত দরকার আমি আপনাদের দিয়ে যাবো, কোনো চিন্তা নেই।
মীরজাফরকে বোঝাতে একটু বেগ পেতে হলো। তিনি প্রথমে বলেছিলেন, আমি নবাব আলীবর্দীর আত্মীয়, অতএব সিরাজউদ্দৌলাও আমার আত্মীয়; কী করে তা সম্ভব? তখন উমিচাঁদ বুঝিয়েছিলেন, আমরা তো আর সিরাজকে মেরে ফেলছি না অথবা আমরা নিজেরাও নবাব হচ্ছি না, শুধু তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করে আপনাকে বসাতে চাইছি। কারণ আপনাকে শুধু আমি নই, ইংরেজরা এবং মুসলমানদের অনেকেই আর এক কথায় অমুসলমানদের প্রায় প্রত্যেকেই গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে।
এবারে মীরজাফর আমীর চাঁদের (উমি চাঁদ) বিষপান করলেন। আমীর চাঁদের জয় হলে তিনিও পুরস্কৃত হবেন। আর মীরজাফর হবেন বাংলার নবাব। এদিকে জগৎশেঠের শোষণের পথ হবে নিষ্কণ্টক আর ইংরেজদের লাভ হিসেবে ভারত এসে যাবে তাদের হাতের মুঠোয়। পক্ষান্তরে সিরাজউদ্দৌলার লাভ হলে তা হতো বাংলা তথা সমগ্র ভারতের লাভ।
যা হোক, ষড়যন্ত্রের জাল বোনা যখন শেষ, ভারতের স্বাধীনতার সূর্যকে যখন পরাধীনতার গ্লানিতে সমাধিস্থ করার সকল পরিকল্পনা প্রস্তুত, সেই সময় ১৭৫৭ সালেন ১৩ জুন ক্লাইভ মাত্র তিন হাজার দুশ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধ যাত্রা করেন। ১৯ জুন নবাবের অধীনস্থ কাটোয়া ক্লাইভের দখলে আসে। ২২ জুন গঙ্গা পার হয়ে ক্লাইভ মধ্যরাতে নদীয়া জেলার সীমান্তে পলাশীর আম বাগানে পৌছান। নবাবের বহুগুণ বেশি সুদক্ষ সেনা আগে থেকেই তৈরী ছিলো। ক্লাইভের তবুও ভয় নেই। কারণ, তিনি জানেন এ যুদ্ধ নয়, পুতুল খেলা মাত্র। আগে হতেই পরিকল্পনা পাকাপাকি। আমীর চাঁদ, রায়দুর্লভ, জগৎশেঠ প্রভৃতির সাজানো সেনাপতি আজ ভেতরে ভেতরে ক্লাইভের পক্ষে, সুতরাং বিজয় হয়েই আছে।
ক্লাইভের সৈন্য যেখানে ৩ হাজার ২ শত সেখানে নবাবের সৈন্য ৫০ হাজার। কারো কারো মতে আরো বেশি। কিন্তু মীরজাফর, রায়দুর্লভ ও অন্যান্য সেনাপতি পুতুলের মতো দাড়িয়ে রইলেন আর ইংরেজ আক্রমণ ও গুলির আঘাতে নবাবের সৈন্যরা আত্মহত্যার মতো মরতে শুরু করলো। এ অবস্থায় সেনাপতির বিনা অনুমতিতেই সিরাজের জন্য তথা দেশ ও দশের জন্য মীরমর্দান বীরবিক্রমে যদ্ধে ব্যাপৃত হলেন আর পরক্ষণেই বিপক্ষের নির্মম গুলিতে বীরের মতো শহীদ হলেন। নবাব সিরাজ এই সংবাদ পেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ঐ সময় যুদ্ধের গতি নবাবের পক্ষে যাচ্ছিল। কারণ মীরমর্দানের সাথে মোহনলাল ও সিনফ্রে  তখন ইংরেজদের কায়দা করে ফেলেছিলো। এমন শুভ মুহূর্তে নবাবের প্রধান সেনাপতি মীরজাফর যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিলেন। রায়দুর্লভের অনুরোধে নবাবও তা অনুমোদন করলেন। ক্লাইভ এই মুহূর্তেরই অপেক্ষায় ছিলেন। নীরব সৈন্যদের ওপরে এবার গোলাবর্ষণ শুরু হলো। অবশেষে নিরুপায় হয়ে নবাবের সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। নবাবও রাজমহলের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে গিয়ে পরিকল্পনানুযায়ী ধরা পড়লেন  এবং তাঁতে বন্দী হতে হলো। শেষে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো।
দেশের বিশ্বাসঘাতক সন্তানেরা এটা বোঝেনি যে, এ পরাজয় সিরাজের নয়, শুধু বাংলার নয় সারা ভারতের। আর ঐ জয় ইংরেজদের ও ইংল্যান্ডের।
কিন্তু সিরাজ পরাজিত ও নিহত হলেন কেন? তাঁর অযোগ্যতাই কি পরাজয়ের কারণ? এর উত্তরে বলা যেতে পারে, পলাশীর যুদ্ধ কোনো যুদ্ধই ছিলো না। এটা ছিলো যুদ্ধযুদ্ধ খেলা। আসলে যাদের তিনি বিশ্বাস করতেন, সেই উমিচাঁদ, সেনাপতি রায়দুর্লভ. প্রধান সেনাপতি মীরজাফর, দেওয়ান রামচাঁদ, মুন্সি নবকৃষ্ণ আর বঙ্গের শ্রেষ্ঠ ধনী জগৎশেঠ এরাই ছিলেন সিরাজের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রকাশ্য শত্রুর দ্বারা যত ক্ষতি হয়, বন্ধু শত্রু হলে আরো মারাত্মক। পলাশীর যুদ্ধে এই সত্যই দারুণভাবে প্রমাণিত। তাই নিরপেক্ষ বিখ্যাত লেখক শ্রীনিখিলনাথ রায় লিখেছেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর সে ভয়াবহ বিপ্লবে প্লাবিত হইয়া হতভাগ্য সিরাজ সামান্য তৃণের ন্যায় ভাসিয়া গিয়াছিল এবং মীরজাফর ও মীরকাসিম ঊর্ধ্বক্ষিপ্ত ও অধঃক্ষিপ্ত কেহ বা অনন্ত নিদ্রায় কেহ কেহ বা ফকিরি অবলম্বনে নিষ্কৃতি লাভ করেন। জগৎশেঠগণের ক্রোধ ঝটিকা সেই তুফান সৃজনের মূল। দুঃখের বিষয় সেই ভীষণ তুফানে অবশেষে তাহাদিগকেও অনন্তগর্ভে আশ্রয় লইতে হইয়াছিল। যে বৃটিশরাজ রাজেশ্বরীর শান্তিধারায় আসমুদ্রহিমাচল স্নিগ্ধ হইতেছে জগৎশেঠগণের সাহায্যই তাহার প্রতিষ্ঠাতা।
একজন ইংরেজ লিখিছেন যে, হিন্দু মহাজনদের অর্থ আর ইংরেজ সেনাপতির তরবারি বাংলার মুসলমান রাজত্বের বিপর্যয়ের কারণ। যে ব্রিটিশ রাজলক্ষীর কিরীট-প্রভায় সমস্ত ভারতবর্ষ আলোকিত হইতেছে, মহাপ্রাণ জগৎশেঠগণের অর্থবৃষ্টিতে ও প্রাণপাতে তাহার অভিষেক ক্রিয়া সম্পাদিত হয়। [ঐতিহাসিক চিত্র, ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা দ্রষ্টব্য ]
শ্রীবিনয় ঘোষও তাঁর ভারতজনের ইতিহাস গ্রন্থের ৫১৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, আজকের যে কোনো বালকও বুঝিতে পারে যে পলাশীর যুদ্ধ শুধু যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ছাড়া আর কিছুই ছিলো না।
ইংরেজ ঐতিহাসিক সি. ম্যালেসনও তার গ্রন্থে লিখেছেন, ÒPallassey, then, though a decisive can never be considered a great battle.” [Decisive battle of India, p-73]
তাহলে ভরতের মানুষের এত বড় সর্বনাশ সাধন করার উদ্দেশ্য কী? এর উত্তরে অনেকে অনেক কথা বলেন। তবে একদল বিচক্ষণ প-িতের মতে সাম্প্রদায়িকতাই তার প্রধান কারণ। মুর্শিদাবাদের কথা বলতেই মনে পড়ে যায় মুসলমান মুর্শিদকুলি খাঁর নাম। কিন্তু তিনি মুসলমান ছিলেন বলেই তার অপরাধ ছিলো না, বরং তাঁর অপরাধ ছিলো তিনি ব্রাহ্মণের সন্তান হয়েও ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন [এশিয়াটিক সোসাইটির সংরক্ষিত অক্ষয়কুমার মৈত্র সম্পাদিত ঐতিহাসিক চিত্র দ্রষ্টব্য]
পৃথিবীর ইতিহাস সমালোচনা করে জানা যায় ইংরেজরা মুসলমান শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে বারবার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরাজিত হয়েছে। তার ফলস্বরুপ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে সারা বিশ্বে মুসলমান রাষ্ট্রের প্রাচুর্য। ক্রুসেডের যুদ্ধগুলোতে মুসলমানদের বীরত্ব অস্বীকার করা সম্ভব নয়। ভারতে ব্যবসাদার ইংরেজ রাজা হয়ে বসতে পারত না যদি তাদের সাথে ভারতের বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতা না থাকত।
ভারতের যোধপুরের এক দরিদ্র পরিবরের হীরানন্দ নামে এক ব্যক্তি বঙ্গদেশেরই এক গ্রামে কিছু গুপ্তধন পেয়ে উন্নতির শিখরে উঠতে থাকেন। স্বভাবতই তাঁর প্রতি অনেকেই নজর দেন বা আকৃষ্ট হন। সেই বংশেরই মানিক চাঁদের সাথে মুর্শিদকুলি খাঁর ভলোবাসা হয়। মানিক চাঁদও ভাগ্যক্রমে কাজ গুছিয়ে বেশ উঁচু ধাপে উঠতে থাকেন। ১৭১৫ সালে বাদশাহ ফররুখ শাহের কাছে সুপারিশ করে মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁকে শেঠ উপাধি দান করেন। হিন্দু-মুসলমানের ভালোবাসার এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত এই শেঠ উপাধি দান।
[রিয়াজুস সালাতিন; Stewart: History of Bengal দ্রষ্টব্য ]
শেঠ বংশের ফতেহ চাঁদই প্রথম জগৎশেঠ উপাধিপ্রাপ্ত হন। রিয়াজুস সালাতিনের ২৭৪ পাতায় পাওয়া যায়, মুহম্মদ শাহ ঐ জগৎশেঠ উপাধি দিয়েছিলেন; তার সাথে মোতির মালা এবং কয়েকটি হাতি। স¤্রাট মুহাম্মদ শাহকে শেঠজীরা তোষণ ও সেবায় এত পরিমাণ মুগ্ধ করেন যে মুর্শিদকুলি খাঁর ওপর বিরক্ত হয়ে তিনি ফতেহ চাঁদকেই নবাব করতে চেয়েছিলেন। মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর সময়ে তাঁর টাকা শেঠজীদের বাড়িতে যা জমা ছিলো তার পরিমাণ সে বজারের সাত কোটি টাকা; যা শেঠজীরা ফেরত দেননি। [নিখিলনাথ রায়: মুর্শিদাবাদ কাহীনি, পৃ-৫৬]
ঐ অর্থই হয়েছিলো যত অনর্থের মূল। সারা ভারতে বহু স্থানে শেঠদের গদি ছিলো। ইংরেজরা প্রথমে শেঠদের হাত করে এবং শেঠরা যত টাকা প্রয়োজন দিতে প্রতিশ্রুত হন। তারপরেই জগৎশেঠের বাড়িতে গোপন বৈঠক বসে। সেই সভাতে সাহেবদের সঙ্গে সারা ভারতকে তথা সিরাজকে ধ্বংস করতে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হচ্ছেন জগৎশেঠ, রাজা মাহেন্দ্র রায় (রায় দুর্লভ), রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, কৃষ্ণদাস, মীরজাফর ও আরো কয়েকজন।
যবনকে নবাব না করে একজন হিন্দুকে নবাব করার জন্য একজন প্রস্তাব দেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মুসলমান মীরজাফরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে লজ্জিত ও থতমত হয়ে বললেন, মীরজাফরকেই নবাব করে আমরা সিরাজকে সরাতে চাই। উদ্দেশ্য, তাতে মুসলমানগণ ক্ষেপে উঠবে না; মুসলমান নবাবের পরিবর্তে মুসলমান নবাব মাত্র। দীর্ঘ কথোপকথনের পর রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কথাই যুক্তিসঙ্গত মনে করে তাঁর ঐ মত চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো। [এর পূর্ণ তথ্য মুর্শিদাবাদ কাহীনিপুরোনো কলকাতার কথাচিত্র এর পৃষ্ঠা ৩৫৭-৩৫৮ দ্রষ্টব্য]
তাই বলা যায়, ভারতে ইংরেজ সম্রাজ্য শুধু তাদের গোলাগুলি এবং বিশ্বাসঘাতকতাতেই  প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং শেঠজীদের বিশ্বাসঘাতকতাই এর পেছনে বিশেষ সহায়ক ছিলো। শেঠজীদের ইংরেজদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা ও গোলামি কোনো অংশেই মীরজাফরের তুলনায় কম ছিলো না বরং ইংরেজদের বিপুল অর্থ সহায়তাই ইংরেজদের এমন দুঃসাহসিক অভিযানের গোড়াপত্তন করেছিলো। ইংরেজ ঐতিহাসিকগণও এই বিরাট সত্যকে হজম করতে পারেননি। তাই বলেছিলেন- ÒThe rupees of the Hindu Banker, equally of the sword of the English colonel contributed to the over through of the Mohammedan power in Bengal.”  বোঝা যাচ্ছে, বাংলায় মুসলমান শক্তিকে ধ্বংস করতে, ভরতকে পরাধীন করতে বৃটিশ সেনাপতির তরবারির সাথে হিন্দু ধনপতিদের অর্থভাণ্ডার ও সমানভাবে সহযোগিতা করেছিলো।
শেঠজীরা শুধু ইংরেজদের হাতেই অর্থ ঢালেননি, সিরাজের সৈন্যদের পর্যন্ত পর্যাপ্ত পরিমাণে অর্থ সরবরাহ করে ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন। আরো দুঃখের কথা, সিরাজকে হত্যা করার প্রস্তাব ইংরেজ সর্দারকে এই জগৎশেঠই দিয়েছিলেন।
মুর্শিদাবাদ কাহীনির লেখক নিখিলনাথ রায় তাই খুব দরদ দিয়ে লিখেছেন-হতভাগ্য সিরাজ রাজ্যহারা সর্বস্বহারা হইয়া অবশেষে প্রাণ ভিক্ষার জন্য প্রত্যেকের পদতলে ভূলুন্ঠিত হইয়াছিল। তাহার প্রাণদানের পরিবর্তে যদি কেহ প্রাণনশের সম্মতি দিয়া থাকে তাহা হইলে তাহারা ঘৃণিত ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক এবয় তাহারা যে সর্বদা নিন্দনীয় এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে।
জগৎশেঠের মৃত্যু হয়েছিল উঁচু পর্বত হতে নিক্ষিপ্ত হয়ে। পৃথিবীর প্রখ্যাত ধনী বংশ দরিদ্র হতে সৃষ্ট হয়ে দরিদ্রতম গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো।
বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার ইতিহাসকে সাহিত্য, নাটক, গ্রামোফোন রেকর্ড ও থিয়েটার প্রভৃতিতে যেভাবে কলঙ্কিত করা হয়েছে তা অত্যন্ত পরিতাপের। নবাব নাকি চরিত্রহীন ও মদ্যপায়ী ছিলেন, তিনি নিষ্ঠুর ছিলেন-এ অপবাদ নাকি প্রমাণিত হয় তাঁর অন্ধকূপ হত্যার দ্বারা। কিছু কম দুশ ইংরেজকে ছোট্ট একটি অন্ধকার  কক্ষে খাদ্য, পানীয় ও বাতাসের অভাব ঘটিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো বলে নিরীহ সিরাজের নামে কলঙ্ক দেয়া হয়েছে। অবশ্য সিরাজ তাঁর কিশোর বয়সে মদ্যপানের কলঙ্কে কলঙ্কিত হয়েছিলেন। কিন্তু নানা আলীবর্দী খান নাতিকে ডেকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করালে তিনি বলেন-নানাজি আপনি নিশ্চিত থাকুন। সিরাজ জীবনে কোনদিন মদ স্পর্শ করবে না। যদি করে তাহলে সে আপনার নাতি নামের কলঙ্ক। বলা বাহুল্য, সিরাজ তা সারাজীবন অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন।
এছাড়াও নারী লোলুপতার মিথ্যা অপবাদও তাঁর ওপর যেভাবে যে পরিমাণে আরোপ করা হয় তাও ইংরেজ ও তাদের দালালদের কৌশলমাত্র।
শ্রী সুধীর কুমার চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, সিরাজ অতিরিক্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক ছিলেন। তিনি প্রায়ই নদীতে বন্যার সময় নৌকা আরোহীদিগকে উল্টাইয়া দিয়া বা ডুবাইয়া দিয়া একসঙ্গে এক দুশ যুবক, যুবতী, স্ত্রী, বৃদ্ধ, শিশু সাঁতার না জানিয়া জলে নিমজ্জিত হওয়ায় নিষ্ঠুর দৃশ্যটি উপভোগ করিয়া আনন্দ লাভ করিতেন।
এই প্রমাণহীন মিথ্যা কাহীনি পড়ে হয়তো অনেকে বলতে পারেন সুধীর বাবু তেমন উল্লেখ্য লোকের মধ্যে গণ্য নন, সুতরাং তার উক্তিতে গুরুত্ব না দেওয়াই ভালো। কিন্তু বিখ্যাত কবি, উচ্চ ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি বাবু নবীনচন্দ্র সেন যদি ঐরকম বা তার চেয়েও মারাত্মক কিছু লেখেন তবে সুধীর বাবুরই বা লেখা দোষের হবে কেনো? নবীনচন্দ্র সেন শুধু নবাবের নৌকায় নরহত্যার কথা সমর্থন করেই ক্ষান্ত হননি, বরং গর্ভিনীর বক্ষ বিদারণ এর মতো রুপকথার সৃষ্টি করেছেন। সিরাজ নাকি জীবন্ত গর্ভবতী নারীর পেট কেটে সন্তান দেখতেন। এমনি আরো কতো আজগুবি আর উদ্ভট ঘটনার অবতারণা করে সিরাজের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার নীচতম প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সিরাজের অন্ধকূপ হত্যার ইতিহাসটিও এমনই একটি কল্পনাপ্রসূত প্রতিচ্ছবি। যাকে সত্যতা দিতে কোলকাতায় ইংরেজরা কুখ্যাত মনুমেন্ট তৈরী করে রেখেছে।

পরবর্তী পোস্টঃ
অন্ধকূপ হত্যা: ইতিহাসের অলীক অধ্যায়


1 টি মন্তব্য:

  1. ঠিক বলেছেন, আপনার কথার সাথে আমি সহমত । কিন্তু আমি জানতে চাই যে , সিরাজ ও আলেয়ার প্রত্র কী সত্যিই যূগোলকিশোর রায়চৌধুরী এবং তিনি সত্যিই কী সিলেটের জমিদার ছিলেন। ঃ

    উত্তরমুছুন

ধন্যবাদ

Blogger দ্বারা পরিচালিত.